ইলার জন্মের পর তার বাবা বড় শখ করে নাম রেখেছিল ইলাবতী, রাজকুমারী ইলাবতী । ছোট করে বলে ‘ইলা’ । চাঁদের মত সুন্দর হয়েছিল নাকি তার ইলা । ইলাবতী নামটা ইলার মোটেও পছন্দ না কারণ যেই শোনে অবধারিত ভাবে সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করবেই,
“তুমি কি হিন্দু ?”
অনুযোগ করলে বাবা হেসে বলতেন, “নামের আবার জাত আছে নাকি রে মা ?”
মেঘ বাড়ির ক্রন্দসী মেয়েরা আজ সারাদিন কাঁদছে । শ্রাবণ মাসটা বোধ হয় তাদের শোকের মাস । তবে তাদের কান্নার সুর বড় মিষ্টি । টিনের চালে তাদের বড়বড় অশ্রুকণা অদ্ভুত এক ঘুম পাড়ানি সুর তোলে রিমঝিম রিমঝিম ! খাটের উপর শুয়ে শুয়ে ইলাবতী কান পেতে সেই গান শুনছে । বৃষ্টি ভেজা সোঁদা গন্ধে চারদিক মাতোয়ারা । বর্ষার দিনগুলোতে মানুষের মন বৃষ্টির মতই ভিজে ওঠে । মন উদাস হয়ে যায় । কি যেন নেই, কিসের যেন অভাব মনে হয় । ইলাবতী অবশ্য তেমন ভাবুক মেয়ে নয় । আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত তার মন অত স্যাঁতসেঁতে নয়, ভিজতে সময় লাগে । বৃষ্টির দিন তারও ভাল লাগে কিন্তু কবিতা তৈরি হয়না । বড় জোর গদ্যময় জীবনের কিছু সোনালী রোদ্দুর নিয়ে নাড়াচাড়া করে ।
এই মুহূর্তে তার দৃষ্টি বাইরের কচু ঝোপের দিকে, ইলাবতী খেয়াল করে বৃষ্টির পানি টুপ করে পাতার উপর পড়ছে কিন্তু দাঁড়াতে পারছে না, কিছুক্ষণ নাচানাচি করে আবার টুপ করে মাটিতে পড়ে মিশে যাচ্ছে । ইলার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে । মনে মনে বলে, মানুষের জীবনও বোধ হয় এমন । কোথা থেকে ঝুপ করে দুনিয়ায় এসে পড়ে কিছুদিন অস্থির সময় কাটিয়ে আবার কোথায় হারিয়ে যায় !
সিরাজদিখান থানার ইছামতীর ধারে ইলাদের দোচালা টিনের ঘর । পাশাপাশি ছোট ছোট তিনটা রূম । একটাতে ইলার অসুস্থ বাবা আর মা দিলারা বানু থাকেন, একটাতে ইলা’রা তিন বোন, অন্য ঘরে ইলা তার ছাত্র ছাত্রীদেরকে পড়ায় । রবিন যখন বাড়িতে আসে তখন এই ঘরটাতেই থাকে । রবিন ইলার একমাত্র ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে । ঘরের পাশেই একটা পেয়ারা গাছ তার নিচে টিউবওয়েল । একচিলতে উঠোনের এক কোণে রান্নাঘর । রাজকুমারী ইলাবতির রাজত্বে এটুকুই রাজপাট ।
ইলার ঘরের জানালা দিয়ে ইছামতি নদী দেখা যায় । ছোট্ট এই নদীতে সারাদিন নানারঙের পালতোলা নৌকার আনাগোনা । নৌকা গুলো গান বাজাতে বাজাতে নিজের গতিপথে ভেসে চলে । লীলা মাঝে মাঝে জানালার ধারে বসে এসব দৃশ্য দেখে আর তন্ময় হয়ে গান শোনে । তার মনে একধরণের উপোসী কষ্ট অনুভূত হয় । এ অনুভূতি শুধু অনুভব করা যায় প্রকাশ করা যায় না । বড় বড় ফোঁটার বদলে এখন তুষার পাতের মত ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে । নদীতে চলমান নৌকা গুলোকে এখান থেকে ঝাপসা মনে হয় । গানের শব্দ ভেসে আসছে , মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না .........।
ইলার বাবা হাসান সাহেব উপজেলার ভুমি অফিসের অফিস সহকারী ছিলেন । ছোটখাটো মানুষ চেহারায় নিতান্তই ভদ্র লোকের ছাপ ! নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়েছে । শোনা যায় ভুমি অফিসের পিওনটারও নাকি ঢাকায় বাড়ি আছে । অথচ হাসান সাহেবের সংসার চলত না । এজন্য অফিস টাইমের বাইরে তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতেন । সেখান থেকে যে আয় আসতো তাতে কোনরকমে সংসার চলে যেত । বাচ্চাদের পড়িয়ে হাসান সাহেব একধরণের তৃপ্তি পেতেন নিজের বাচ্চাদেরকেও তিনি ক্লাস এইট পর্যন্ত নিজেই পড়িয়েছেন । একটা সরকারী অফিসের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী কিভাবে জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠলেন অনেকের কাছে সেটা একটা গবেষণার বিষয় ।
দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হাসান সাহেব পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন তার শরীরের বাম পাশ অবশ, কথা স্পষ্ট হয় না, লিখে লিখে কথা বলেন । পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যাদের অভিধানে দুঃখবোধ বলে কিছু নেই । হাসান সাহেব সেই জাতের একজন মানুষ । তার মতে আল্লাহ যখন যাকে যে অবস্থায় রাখেন সেই অবস্থায় সুখী থাকতে হবে । হাসান সাহেব শুয়ে শুয়ে অনেক সময় কাগজে লেখেন, “মা, আলহামদুলিল্লাহ্ বল ।” ইলা বলে , “আলহামদুলিল্লাহ্ ।”
হাসান সাহেবের চোখ আনন্দে চিকচিক করে আর ইলার চোখের কোণ ভিজে ওঠে । কি অসাধারণ একজন মানুষ তার বাবা !
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে যখন স্কুলে যেত তখন বাবা এক মুহূর্তের জন্য কখনও ইলার হাত ছাড়তেন না । সারারাস্তা ইলা বাবাকে প্রশ্নবাণে অতিষ্ঠ করে তুলত । কি সুন্দর করে বাবা সেইসব অবুঝ প্রশ্নের উত্তর দিতেন । আজ জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে ইলার কত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু তার উত্তর দেওয়ার কেউ নেই । প্রতিবছর রেজাল্ট কার্ডটা বাবার হাতে দিলে বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন ,
“ওমা, আমার ইলাবতী এবারো ফার্স্ট হয়েছে ! ইলার মা, আজ পোলাও হবে ।”
ইলা যেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেল সেদিন বাবার চোখে প্রথম জল দেখেছিল । ইলা বাবার চোখে হাত দিতেই বাবা থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
“থাক মা মুছিস না এমন আনন্দের অশ্রু মানুষের জীবনে খুব বেশি আসে না ।”
ইলা মনে মনে বলেছিল, “ তবে থাক বাবা, এই কান্না আমি বারবার দেখতে চাই ।”
ইলা তখন মেডিকেলে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী । ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের কাজল কেবল গাঢ় হতে শুরু করেছে , তখনই চোখের পানিতে সে কাজল ধুয়ে মুছে গেল । ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন হাসান সাহেব । নিজের শরীরের প্রতি তার কোন নজর ছিল না । বড্ড অনিয়ম করতেন, পরিণামে এই পঙ্গুত্ব । রবিন কাঁদতে কাঁদতে যেদিন ফোন করে বলেছিল, “আপু তুমি তাড়াতাড়ি আস । বাবা ভাল নেই ।”
ইলা হল ছেড়ে সেই এসেছিল আর একবার গিয়েছিল তার জিনিস পত্র আনতে । বাবাকে হাসপাতালের বিছানায় দেখে ইলার বুকের মধ্যে একটা সমুদ্রের জন্ম নিল, ব্যথার সমুদ্র । বাবা যেন নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে থাকে আর জানতে চায় ,
“পারবি মা ?”
প্রতিউত্তরে ইলা নীরবে বলেছিল, “পারবই বাবা, আমি যে তোমার রাজকুমারী ইলাবতী।”
সেই শুরু, তারপর বাবার সংসার তার সংসার হয়ে গেল, বাবার ভার তার ভার । সে কতটুকু পেরেছে আর কতটুকু পারেনি সে হিসেবের সময় এখনো আসেনি তবে এই ভার বইতে তার কখনো ভারী মনে হয়নি । বাবার অফিস থেকে পড়ালেখার খরচ দিতে চেয়েছিল । ইলা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে । তাদের টাকায় হয়ত সে ডাক্তার হতে পারবে কিন্তু তার বাবাকে কে দেখবে ? ছোট তিন ভাইবোনকে কে বড় করবে ? তার ডাক্তার হবার স্বপ্নের কাজল সে তার ভায়ের চোখে পরিয়েছে । রবিন এখন ঢাকা মেডিকেলের ৩য় বর্ষের ছাত্র । প্রথম বছর তার পড়ার খরচ ইলাই দিয়েছে । এখন আর দিতে হয়না , টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই চালায় ।
বাবার চিকিৎসা, ভাইবোনের পড়ালেখা ছাড়াও একটা সংসারের খরচ কম নয় । চালাতে গিয়ে ইলাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে । প্রথমে বাবার ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়ানো শুরু করে । ভাল শিক্ষক হিসেবে খুব দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পড়ে । এরপর বেসরকারি একটা স্কুলে চাকরি হয়েছে । এখন নিজের বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের পড়ায় । সন্ধ্যার পর অন্যের বাড়িতে গিয়েও ছাত্রীদেরকে পড়িয়ে আসে । পাঁচটা টাকা বাঁচানোর জন্য মাইল রাস্তাও হেঁটে পার হয় । রাত জেগে নোট তৈরি করে । বাজার ঘুরে ঘুরে কম দামে ভাল জিনিসটা কেনার চেষ্টা করে । ভাইবোনদের প্রয়োজনের প্রতি ইলার কঠোর দৃষ্টি । অভাব কি আজ পর্যন্ত তারা টের পায়নি । আমাদের সমাজে একা একটা মেয়ের পথ চলা যে কত কঠিন ইলা সেটা হাড়ে হাড়ে জানে ।
পথ চলতে গিয়ে মানুষ নামের কত শ্বাপদের সাথে দেখা । ইলা কঠোরে ,কৌশলে , সাবধানে এসব কিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে । ছাত্রীদেরকে পড়িয়ে বাড়িতে ফিরতে রাত হয় এই নিয়ে প্রতিবেশী আত্মীয়দের অনেকেই নানা কথা শোনায়, উপদেশ দেয়, কিন্তু ইলা তার জীবনবোধ থেকে একটা শিক্ষা নিয়েছে, সেটা হল, অন্যের কথা নয়, নিজের কথা শোন । কারণ তোমার চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তোমার জীবনে আর কেউ নেই।
কখনো কখনো জীবনটাকে কঠিন মনে হয়, হতাশা চলে আসে তখন ইলা এসে বাবার পাশে বসে । কেমন করে বাবা তার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন ।
হাসান সাহেব লেখেন, “মাগো হতাশ হইয়ো না, হতাশা মানুষকে অনেক পিছনে নিয়ে যায় । আমাকে দেখ । আমার মত অসুস্থ মানুষ এখনো সুস্থ মস্তিস্কে তোমার সাথে লিখে সব কথা শেয়ার করতে পারছি শুধুমাত্র মনের জোরে । আমার বিশ্বাস এই মনের জোরেই আমি একদিন পুরো সুস্থ হয়ে উঠব । নিজেকে সব সময় একটা সাজেশন দাও সেটা হল, আমি পারব ।”
ইলা বাবার হাত ধরে তার শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে । সে দুই চোখ বন্ধ করে ফেলে তার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু বাবার কথার প্রতিধ্বনি করে, সম্মোহিতের মত ইলা উচ্চারণ করে, “আমি পারব, নিশ্চয়ই পারব ।”
হাসান সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,
ইলার মা খুব সাদাসিধা একজন মানুষ । রান্না ঘর আর স্বামীর সেবা করেই তার বেশিরভাগ সময় কাটে । মেয়ের সামনে তিনি সবসময় কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে থাকেন । একটা অপরাধবোধে ভোগেন । যে মেয়ে বড় ডাক্তার হতে পারত, সে আজ বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক । কতই বা তখন তার বয়স, তবুও নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ পায়ে ঠেলে, শুধুমাত্র ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে সে কি কঠিন জীবন বেছে নিয়েছে মেয়েটা । ইলার বয়সী মেয়েদের বাচ্চারা স্কুলে পড়ে আর ইলা এখনো বাবার সংসার টানছে ।
কতবার ইলা বলেছে, “মা, পৃথিবীর সব মেয়েকে স্বামীর ঘর করতে হবে এটা তোমাকে কে বলেছে ?”
“আমাদের জন্য তোর কোন সাধ পূরণ হল না রে মা ।” ইলার মায়ের গলা ধরে আসে ।
“ওরে আমার বোকা মা ! তোমরা কি আমার সাধ না ? তোমার ছোট ছেলেমেয়ে গুলো কি আমার আনন্দ না ? আমি তোমার ছেলে হলে এরকম করে বলতে ?” মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে অনুযোগ করে ইলা !
ইলার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ মা , তুই আমার ছেলেরও অনেক বড় ।”
ইলার মায়ের কথা মাঝে মাঝে ইলার মনকে নাড়া দেয় । তার মনের বছর গুলোতেও ঋতুর পরিবর্তন হয় । কখনো বসন্তের ফুল ফোটে, কখনো বর্ষায় দুইকুল ভেসে যায়, আবার কখনো সেখানে গ্রীষ্মের খরাও চলে । ইলার মনেও কিছু সোনালী রোদ্দুর আছে যেগুলো সে কৌটায় বন্দী করে রেখেছে পাছে সেখানে স্নান করতে মন চায় ।ভয় হয় যদি মন লোভী হয়ে যায় ? পূর্ণিমার কিছু কিছু মধ্যরাত বিরূপ হয় । নারীত্ব নির্লজ্জ হয়ে বিপরীতের স্পর্শ পেতে আকুল হয়ে ওঠে । ছোট ছোট শিশু মনের উঠোনে খেলা করে । কল্পনায় ইলা তাদের ছোট মুখ গুলোকে আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে । কিন্তু ওই কল্পনাকে সে রাতের কাছেই জমা রাখে । দিন হতেই বাস্তবতার তপ্ত দুপুর সে জায়গা দখল করে নেয় ।
সেলফোনের মেসেজ টোনে ভাবনাগুলোকে দ্রুত গুছিয়ে ফেলে ইলা । নকিয়ার সস্তা সেট হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করে সে । সারামুখ জুড়ে মিষ্টি বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়ে । সে বিকেলে একটু রক্তিমআভা যেন চকিতে খেলে যায় ।
অর্ণব লিখেছে, “কি কর ?”
“বৃষ্টি দেখি, তুমি ?”দ্রুত হাতে রোমান হরফে বাংলা উচ্চারণে লেখে ইলা ।
“আমিও । চল, বৃষ্টিতে ভিজি ।”
“ইস......শখ কত !”
“আহা ! তুমি বড় সেকেলে হয়ে যাচ্ছ ইলা !”
“হলামই । আর একালের ছিলামই বা কবে ?”
“আহা রাগ কর কেন ?”
“রাগ করলাম বুঝি ? হাহাহা !”
“সত্যি বলছি ইলা, কোনদিন কি আমাকে বুঝবে না ?”
“তোমাকে তো কতবার বলেছি, তোমার নৌকায় ওঠার মত সাহস বা সুযোগ কোনটাই আমার নেই ; তুমি তো সব জান । “
“সে আমি জানি তবুও মন মানে না । সে যাক একটা গান শুনবে ?”
“হুম, বল । “
“O the desire of my heart, you are, you are.
Without you in this world I have no one, no part.
If you are discontented, then go to seek contentment.
I have you within my heart's core. I want for no more”
“আমারও পরান যাহা চায় । “
“ঠিক তাই ।”
“ওকে । আমার যাবার সময় হল । পড়াতে যেতে হবে । ভাল থেকো ।”
“ভাল থেকো আমার ইলাবতী ।”
“অর্ণব” ইলার ছোট্ট আর একটা জগতের নাম । যেটা তার একান্তই নিজের । সেখানে হাসি আছে, আনন্দ আছে, অভিমান-বেদনা সব আছে । ইলা যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে অর্ণব তখন থার্ড ইয়ারে । বান্ধবী সেঁজুতির মাধ্যমে প্রথম পরিচয় । তারপর কিভাবে কিভাবে যেন সে ইলার জীবনের সকালসন্ধ্যা হয়ে যায় । ক্লাসের ফাঁকে শেষ বিকেলের অবসরে তাদের কথাগুলো সুর পেয়ে বাঙময় হয়ে উঠত । ইলা হল ছেড়ে চলে আসার সময় অর্ণবকে কিছু বলে আসেনি । পিছুটান রাখতে চায়নি । ফোন নম্বরও বদলে ফেলে । কিন্তু, অর্ণবকে সে আটকে রাখতে পারেনি । এক বিকালে অর্ণব ইলাদের বাড়িতে পাগলের মত এসে হাজির হয় । ইলা অনেক তার পরিবারের অবস্থা বুঝিয়ে বলেছিল ইলাকে সে যেন ভুলে যায় । কারণ তাদের গ্রন্থি একসাথে বাঁধা সম্ভব নয় । সেও প্রায় ছয় বছর আগের কথা । অর্ণব এখন হাসপাতালের ডাক্তার । এখনো অর্ণব ইলাকে মনে করিয়ে দেয় সে ইলার অপেক্ষায় আছে ।
বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে । তবে আকাশ ঘনকালো মেঘে ঢাকা । যে কোন সময় ঝুম বর্ষা নামবে । ইলা বাবার কাছে এসে বসে তার মাথায় হাত রাখে । মেয়ের স্পর্শে ধীরে চোখ খোলে হাসান সাহেব ।
বাবা, যাই ?
হাসান সাহেব একটু হেসে মাথা কাত করেন ।
বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবা আর মেয়ের মধ্যে প্রতিদিনকার এই সাক্ষাৎকারটুকু অনিবার্য ।
বৃষ্টির কারণে আজ দুই বাসায় পড়াতে যেতে পারেনি । প্রমিদের বাসায় যেতেই হবে । কারণ সামনেই ওর এস.এস.সি পরীক্ষা । প্রমি ছাত্রী হিসেবে খারাপ নয় । তবে তার পিছনে ইলাকে অনেক খাটতে হয় । কিন্তু, প্রমিদের বাসায় যত সময় থাকে ইলা মোটেই স্বস্তিতে থাকে না । প্রমির বাবা জিন্নাহ সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী, ইলা তাকে চাচা বলে ডাকে । ভদ্রলোকের চাহনি মোটেই ভাল না । ইলার দিকে যখন তাকায় মনে হয় তার শরীরটাকে সে চোখ দিয়ে গিলছে । ইলা সে দৃষ্টির সামনে জড়সড় হয়ে যায় । মেরুদণ্ড বেয়ে ঘৃণার একটা স্রোত বয়ে যায় ।
নানা বাহানায় ইলার কাছে আসার চেষ্টা করে জিন্নাহ সাহেব । মা, মা বলে পিঠে হাত বুলায় । ইলা বুঝতে পারে এই স্পর্শ কোন চাচার না, একজন কামুক পুরুষের । সে ঘৃণায় হাত সরিয়ে দেয় “বুড়া বদ”বলে মনে মনে গালিও দেয় । ইলা অনেকবার ভেবেছে টিউশনিটা ছেড়ে দেবে কিন্তু বাস্তবতা তাতে বাঁধ সেধেছে । একদিকে মেয়েটার প্রতি তার একটা মায়া এবং দায়িত্ববোধ তৈরি হয়েছে । অন্যদিকে প্রমিকে পড়িয়ে সে যত টাকা পায়, সেটা কম নয় । মানুষের প্রয়োজন বড় খারাপ । বিপদের ঝুঁকি জেনেও প্রয়োজন মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে ।
প্রমিদের বাসার সামনে আসতে আসতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে । আজ ইলার মনে নানা অশুভ চিন্তা আসছে । কলিং বেল এ চাপ দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, ভাবছে ফিরে যাবে কিনা । এমন সময় দরজা খুলে যায়, সামনে জিন্নাহ চাচা ।
“আরে, ইলা মা ? আস, ভিতরে আস ।” জিন্নাহ সাহেবের মুখে তেলতেলে ভাব ফুটে উঠেছে ।
ইলা শুষ্ক মুখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, “চাচা, প্রমিকে পাঠিয়ে দেন ।”
“অস্থির হচ্ছো কেন ? আসছ যখন, বস । একটু গল্প করি । ওরা সবাই ওদের মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছে । এসে পড়বে ।”
“তাইলে আমি যাই চাচা, কাল আসব । ” ঝট করে উঠে দাঁড়ায় ইলা ।
“ওরা নেই তো কি হয়েছে ? বস, চা খাও । আমি ভাল চা করতে পারি । ততক্ষণে ওরা চলে আসবে ।”
অজানা ভয়ে ইলার বুক কেঁপে উঠে এমনিতেই সন্ধ্যা তার উপর বৃষ্টি বাদলের দিন । জিন্নাহ চাচার মনোভাব মোটেই ভাল মনে হচ্ছে না । বিপদে পড়লে চিৎকার করলেও কেউ শুনবে
ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠে ইলা । দ্রত দরজার দিকে পা বাড়ায় সে। “না চাচা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমি যাই ।”
“একটু দাঁড়াও ইলা । ” জিন্নাহ সাহেব ইলার হাত টেনে ধরে ।
“ছি চাচা । কি করছেন ? হাত ছাড়েন বলছি ।” ঘৃণায়, ক্ষোভে, ইলার মুখ রক্তিম হয়ে উঠে ।
জিন্নাহ হাত না ছেড়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আরও কাছে আনে । ইলা দেখতে পায় জিন্নাহর মুখ আস্তে আস্তে জানোয়ারের মুখে পরিণত হচ্ছে । তবে সেটা শুয়োর, হায়েনা নাকি গরিলা বুঝতে পারছে না । একথা সত্যি যে মাঝে মাঝে নির্ঘুম কোন রাতে পুরুষের স্পর্শ পেতে তার নারী শরীর জেগে উঠে কিন্তু এই স্পর্শ তো সেটা নয় । লজ্জা, অপমান, ঘৃণায় ইলার শরীর জ্বলছে । সে চোখ বন্ধ করে । বাবার মুখ মনে করে ডাকে , ‘বাবা’ । তার ভেতর থেকে বাবা যেন বলে ওঠেন, “ইলা জেগে ওঠ । উঠে দাঁড়াও মা ।”
সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইলা । তার ইচ্ছাশক্তির কাছে অপশক্তির পরাজয় ঘটে । এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদলা থুথু নিক্ষেপ করে জিন্নাহ নামের পুরুষের মুখে । তারপর ছিটকিনি খুলে বের হয়ে আসে খোলা আকাশের নীচে । ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি । ইলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে । একদিকে মেঘ বালিকাদের অশ্রু অপরদিকে একলা এক সংগ্রামী ধরিত্রী কন্যার চোখের নোনাজল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । এই জলধারায় ধুয়ে যেতে থাকে মুছে যেতে থাকে রাজকুমারী ইলাবতীর মনের সমস্ত গ্লানি, কষ্ট । আর এভাবেই বৃষ্টিস্নাত হয়ে বারবার উঠে দাঁড়ায় এ জগত সংসারের ইলাবতীরা ।